ইভাঞ্জেলিক্যালিজম ও জায়োনিজম

ইভাঞ্জেলিক্যালিজম ও জায়োনিজম

ইজরাইলি প্রেসিডেন্ট বেনজামিন নেতানিয়াহুর পিতা ইহুদি ইতিহাসবিদ বেনজিওন নেতানিয়াহু ২০১২ সালে The Founding Fathers of Zionism নামে একটি বই লিখেন, যেখানে তিনি জায়োনিজমের গোড়াপত্তনকারী পাঁচ ব্যক্তির অবদান নিয়ে আলোকপাত করেন—ম্যাক্স নর্ডাও, থিওডোর হার্জেল, ইজরাইল জ্যাংউইল, লিও পিন্সকার ও জি’এভ জ্যাভটিন্সকি। কিন্তু এই ভদ্রলোক জায়োনিজমের সত্যিকারের পিতার কথা মেনশন করতে ভুলে যান, যার মাথা থেকেই এই ধারণা বেরিয়েছিল—লর্ড শ্যাফটসবেরী। তিনিই সর্বপ্রথম ইহুদিদেরকে প্যালেস্টাইনে ফিরে যাওয়ার কথা বলেন। ইউরোপের প্রোটেস্ট্যান্ট রাজাদের কাছে মেমোরেন্ডাম পাঠিয়ে তিনি জেরুজালেমে ব্রিটিশ এম্বাসি খোলার ও একটা বিশপ পাঠানোর অনুরোধ করেন। স্কটিশ পাদ্রি শ্রদ্ধেয় অ্যালেকজান্ডার কিইথ ১৮৩৯ সালে প্যালেস্টাইন ভ্রমণ করেন; অতঃপর ১৮৪৩ সালে তিনিই সম্ভবত প্রথম “a land without a people, for a people without a land. ভূমিহীন মানুষদের (অর্থাৎ, ইহুদিরা) জন্য মানুষহীন ভূমি (অর্থাৎ, প্যালেস্টাইন)” নামক বুলিটি আওড়ান। অথচ ফিলিস্তিনে তখনো ৩ ধর্মের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষের বসবাস ছিল। লর্ড শ্যাফটসবেরীই প্রথম Palestine Exploration Fund এর উদ্যোগ গ্রহণ করেন, যেটি কিছু মানুষের মতে বাইবেলের ঐ আয়াতের সমর্থনে প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ খোঁজার জন্য সর্বপ্রথম কাজ শুরু করে।

১৮৫৬ সালে তাদের প্রথম সাক্ষাতের পর ইয়র্কের আর্চবিশপ তার বক্তব্যে বলেন, “এই প্যালেস্টাইন দেশটির মালিক আমরাই। এটি আমাদেরকেই দেওয়া হয়েছে। এটি ইজরাইল জাতির পিতাকে এই বলে দেওয়া হয়েছে যে, ‘অতএব এগিয়ে যাও, তোমার নিজের দেশে তুমি হেঁটে বেড়াও। এই দেশ আমি তোমায় দিলাম।’ আমাদেরকে প্যালেস্টাইনের অগ্রে-পশ্চাতে হাঁটতে বলা হয়েছে, কারণ এটি আমাদেরকে দেওয়া হয়েছে।” এটি তখন সবার মধ্যে একটা চিন্তার খোরাক জন্মায়। জায়োনিজম ধারণার গোড়াপত্তনে ইভাঞ্জেলিক্যাল খ্রিস্টানদের ভূমিকার ব্যাপারে ইজরাইলি ইতিহাসবিদ আনিতা শাপিরা বলেন, “প্রোটেস্ট্যান্টরাই বাইবেলের এই ধারণাটি আবিষ্কার করে ইহুদি সমাজে প্রবেশ করিয়ে দেয়। বাস্তবতা হলো; খ্রিস্টান পাদ্রিদের মাথায় জায়োনিস্ট ধারণাটি শূন্য থেকে নাযিল হয়নি, বরং বাইবেল থেকেই এই ধারণার উৎপত্তি হয়।”

এই ইভাঞ্জেলিক্যাল খ্রিস্টানরা ইহুদিদেরকে প্যালেস্টাইনে পুনর্বাসিত হতে সাহায্য করার পেছনে যুক্তি হিসেবে প্রধানত দুইটি শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা দাঁড় করায়। প্রথম ব্যাখ্যাটি যে আয়াতের মাধ্যমে সমর্থিত, সেটি হলো, “যারা তোমাকে আশীর্বাদ করবে, সেই লোকেদের আমি আশীর্বাদ করব এবং যারা তোমাকে অভিশাপ দেবে, সেই লোকেদের আমি অভিশাপ দেব। তোমার মাধ্যমে আমি পৃথিবীর সব লোকেদের আশীর্বাদ করব।” ইহুদি জাতির লোকেরা ইতিহাস জুড়ে পারস্যের রাজা নেবুচাদ নেজার ও মিশরের ফারাও থেকে শুরু করে খ্রিস্টান ও আধুনিক যুগে হিটলার কর্তৃক অবর্ণনীয় নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েছে। তাদেরকে পুর্বপুরুষদের ভূমিতে ফিরে গিয়ে একটা নিরাপদ জীবন যাপন করতে ও সেখানে সমৃদ্ধি অর্জনে সাহায্য করার চেয়ে বড় উপকার আর হতে পারে না। ইভাঞ্জেলিক্যাল খ্রিস্টানরা বিশ্বাস করে যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র যে বৈষয়িক উন্নতি অর্জন করেছে তা ইহুদিদেরকে সাহায্য করার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং ইতিহাস জুড়ে খ্রিস্টানরা যখনই মুসলমানদের হাতে পরাজিত হয়েছে বা অন্য কোন বিপদ তাদের মাথায় চেপেছে তার কারণ ছিল, অতীতে তারা ইহুদিদের সাথে উত্তম ব্যবহার করেনি। ফিরআউনের সলীল সমাধি ও হিটলারের পতনও তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী একই ধারায় গাঁথা।

দ্বিতীয় যে ব্যাখ্যাটি পাওয়া যায় সেটি হলো, প্রতিশ্রুত ভূমিতে ইহুদিদের পুনর্বাসনের মাধ্যমে যীশু খ্রিস্টের পুনরাগমন ঘটবে এবং এভাবে খ্রিস্টানরা ইহুদিদেরকে তাদের ঐতিহাসিক পাপের জন্য শাস্তি দিতে পারবে (যীশু খ্রিস্টকে ক্রুশবিদ্ধ করতে পন্টিয়াস পাইলেইটকে সহায়তা করার পাপ)। তখন তাদেরকে হত্যা আর না হয় খ্রিস্ট ধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়ার জন্য বাধ্য করার মাধ্যমে যীশু হত্যার প্রতিশোধ নিতে পারবে। তবে ইহুদিরা অবশ্য এরকম কোন কিছু ঘটতে পারে বলেও বিশ্বাস করে না এবং এই কারণে তারা খ্রিস্টানদের এই পরিকল্পনাটি জেনেও এই ব্যাপারে উদাসীন। তারা শুধুমাত্র তাদের প্রতিশ্রুত ভূমিতে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারেই কেয়ার করে। বাইবেলের যে আয়াতটি এই ধারণাকে সমর্থন করে সেটি হলো, “দেশের দুই-তৃতীয়াংশ লোক আঘাতে মারা যাবে কিন্তু এক-তৃতীয়াংশ অবশিষ্ট থাকবে। তখন আমি ঐ অবশিষ্ট এক তৃতীয়াংশ লোকেদের পরীক্ষা করব। আমি তাদের বিভিন্ন সংকটে ফেলব। সেগুলো হবে তাদের অগ্নিপরীক্ষার মতো ঠিক যেমন লোকেরা আগুন ব্যবহার করে রূপোকে খাঁটি করতে অথবা সোনা খাঁটি কিনা তা পরীক্ষা করতে। তখন তারা আমার নামে ডাকবে আর আমি তাদের ডাকে সাড়া দেব। আমি বলব, ‘তোমরা আমার লোক।’ আর তারা বলবে, ‘প্রভু আমাদের ঈশ্বর’।”১০

যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্যের অন্যান্য দেশের অনেক ইভাঞ্জেলিক্যাল খ্রিস্টান অবশ্য পরের যুক্তিটা বড় গলায় অস্বীকার করে, অনেকে এমন নোংরা পরিকল্পনার কঠোর নিন্দাও করে। তারা শুধুমাত্র প্রথম যুক্তিটাকে স্বীকৃতি দেয়। তারা দাবি করে যে, ইহুদিরা তাদের ভাইয়ের মতো এবং অমন নোংরা পরিকল্পনার মাধ্যমে তাদের ক্ষতি করার কথা তারা চিন্তাও করতে পারে না। সেই সাথে তারা মধ্যযুগের খ্রিস্টানরা ইহুদিদের সাথে যে বর্বরতা আর শয়তানি প্রদর্শন করেছে, সেসবকে সত্যিকারের খ্রিস্টান ধর্ম থেকে বিচ্যুতি ও ধর্মের বিকৃতি বলে অভিহিত করে। এজন্য তারা ইহুদিদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করে এবং এসবের জন্য লজ্জিত বলে ক্ষমা প্রার্থনাও করে।

কিন্তু তাদের এই প্রথম বিশ্বাসটি কয়েকটি কারণে ভ্রান্ত। প্রথমত, এর মাধ্যমে ঈশ্বর ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের চেয়ে ভৌগলিক জাতীয়তাবাদের ধারণাকে অধিক পছন্দ করেন ধারণা করা যেতে পারে। যেহেতু খ্রিস্টানরা ইহুদিদেরকে সহায়তা করছে, এর প্রাপ্তিস্বরূপ শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের খ্রিস্টানদের নয়, বরং সমগ্র বিশ্বের সকল খ্রিস্টানদের আশীর্বাদ করার কথা ছিল। কিন্তু পৃথিবীর অন্যান্য দেশের খ্রিস্টানদের (উদাহরণস্বরূপ, আফ্রিকার দেশগুলো) দুরাবস্থার কারণে তাদের উপর ঈশ্বরের ক্ষিপ্ত হওয়ার প্রশ্ন উঠে। তাছাড়া, তাদের প্রথম দাবিটি যদি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ক্ষমতা হারালো কেন? তারা যুদ্ধে জিতেছে ঠিকই; কিন্তু, এরপর থেকে তারা একে একে নিজেদের সকল দখলকৃত ভূমি হারাতে থাকে। অথচ প্রতিশ্রুত ভূমিতে ইহুদিদের পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে একমাত্র তারাই ভূমিকা রেখেছিল। ১৯৪৮ সালে ইজরাইল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সময় যুক্তরাষ্ট্রের সামষ্টিক প্রশাসন থেকে ইহুদিরা কোন সহায়তা পায়নি বললেই চলে। শুধু কতক ব্যক্তিবিশেষের সহায়তা পেয়েছিল, যারা নিজেরা ইহুদি ছিলেন। আর ১৯৪৮ সাল থেকেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের উপনিবেশগুলোতে তাদের নিয়ন্ত্রণ ক্ষীণ হয়ে আসে। এই কারণে ইজরাইলের প্রতিও তাদের সমর্থন কমতে থাকে। উপরন্তু, যদি এই বিশ্বাসটি সত্য হয়ে থাকে, এর মাধ্যমে ঈশ্বরকে ধর্ষকামী (যে অন্যের দুঃখ-কষ্ট দেখে আনন্দিত হয়) বলে বিবেচনা করা যেতে পারে। কারণ, এই পৃথিবীতে যুক্তরাষ্ট্রের উত্থান হয়েছে লক্ষ লক্ষ নিরীহ মানুষের জীবন ও রক্তের উপর। যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা আর একাধিপত্য অর্জন নিঃসন্দেহে সম্ভব হয়েছে মানবাধিকার লঙ্ঘন, আগ্রাসন ও ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করার মাধ্যমে।

তবে দ্বিতীয় ধারণাটি যুক্তরাষ্ট্রের অনেক ইভাঞ্জেলিক্যাল খ্রিস্টান সমর্থন করেন, যারা বিশ্বাস করেন যে, যীশু খ্রিস্টের পুনরাগমন একমাত্র প্রতিশ্রুত ভূমিতে ইহুদিদের পুনর্বাসনের মাধ্যমেই সম্ভব। খ্রিস্টীয় ইভাঞ্জেলিক্যালরা অনেক সময় প্যালেস্টাইনিয়ানদের প্রতি দয়াপ্রদর্শন ও জর্জ ডব্লিউ বুশের গৃহীত দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান (Two-state solution) পদক্ষেপ সমর্থন করার মাধ্যমে এই দাবিটি অস্বীকার করে। প্রেসিডেন্ট বুশ নিজেও প্যালেস্টাইনে দুইটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ধারণার কট্টর সমর্থক ছিলেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র দুইটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ নিজেদেরকে মানবতাবাদী বলে প্রমাণ করার জন্য নেয়নি; বরং, এর পেছনে দুইটি যুক্তি আছে। প্রথমত, বহু বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র দেশে দেশে যে সকল সাম্রাজ্যবাদী হামলা চালিয়েছিল সেগুলোর কারণে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক সুনাম ক্ষুন্ন হয়েছে এবং সেটা পুনরুদ্ধারে প্যালেস্টাইনিয়ানদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। দ্বিতীয়ত, ইভাঞ্জেলিক্যাল বিশ্বাস অনুযায়ী যীশু খ্রিস্টের আগমন ত্বরান্বিত করতে প্রতিশ্রুত ভূমির পুরো অংশজুড়ে ইহুদিদের বসবাস ও সেখানে একচেটিয়া ক্ষমতার অধিকারী হওয়া গুরুত্বপূর্ণ নয়। ইহুদিরা সেখানে বিশাল একটা সংখ্যায় উপস্থিত থাকতে পারলেই হবে এবং সেটা ইতোমধ্যেই বাস্তবায়িত হয়েছে। তাই দুই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার এই ধারণা ইজরাইলকে একটা নিরাপদ আবাসন ও তার পাশাপাশি স্বনির্ভর প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে, যারা একে অপরের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করতে ও নিজেদের দেশে জঙ্গিবাদ দমন করতে একমত হবে।১১

ইভাঞ্জেলিক্যাল খ্রিস্টানদের প্রথম বিশ্বাসকে সত্য বলে দাবি করার পথে আরও একটি কাঁটা আছে—‘প্রতিশ্রুত ভূমি’তে ফিরে যাওয়া। ইহুদিদেরকে এ’ভূমিতে পুনর্বাসনে সহায়তা করার উদ্দেশ্যটি দ্বিমুখী। ইংল্যান্ডের পালমারস্টোনসহ ইভাঞ্জেলিক্যালিজমের ধারণাটি যারা সৃষ্টি করেছিলেন, ইহুদিদের প্রতিশ্রুত ভূমিতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তাদের প্রাথমিক প্রণোদনা ছিল ‘যীশু খ্রিস্টের সাম্রাজ্যের আবির্ভাব ঘটানো’, ‘ইহুদিদেরকে মধ্যযুগীয় বর্বরতা থেকে বাঁচানো’ নয়। এটার কোন সাহিত্যিক বা ঐতিহাসিক প্রমাণ না থাকলেও একটা বিষয় থেকে এটা সুস্পষ্ট। যদি ইহুদিদের পুনর্বাসনের পেছনে প্রাথমিক যুগের ইভাঞ্জেলিক্যালদের একমাত্র উদ্দেশ্য থাকত যে, তারা ইহুদিদের নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করবে, সেক্ষেত্রে তারা ইতোমধ্যেই ভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির মানুষ দ্বারা অধ্যুষিত প্যালেস্টাইনকে পছন্দ না করে অন্য কোন জনমানবহীন ভূমির কথা ভাবতে পারত। কিন্তু শুরু থেকেই ইভাঞ্জেলিক্যালদের প্রচার-প্রচারণার মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল প্যালেস্টাইন; উগান্ডা বা কেনিয়া নয়। কেনিয়াতে থিওডোর হার্জেলের ‘উগান্ডা স্কিম’ বাস্তবায়ন করার মাধ্যমে নিজেদেরকে ইহুদিদের হত্যার করার জন্য প্রতিশোধপরায়ণ নয় বলে প্রমাণ করতে পারত।  কিন্তু হার্জেলের এই স্কিম ব্যর্থ হয়। এর প্রধান কারণ ছিল কেনিয়াকে নিজেদের ভূমি হিসেবে মেনে নিতে ও সেখানে নিজেদের আবাস গড়তে ইহুদিদের অনিচ্ছা ও প্রতিরোধ, যারা ইতোমধ্যেই ইভাঞ্জেলিক্যালদের প্রচার-প্রচারণা দেখে কনভিন্স হয়ে গিয়েছিল যে, তাদেরকে নিজেদের পিতৃপুরুষের ভূমিতে ফিরে যেতে পারবে, যেটা এতদিন তারা স্বপ্নেও ভাবতে পারত না। এটা অবশ্য ঠিক যে, তারা শত শত বছর ধরেই প্রতিশ্রুত ভূমিতে ফিরে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা করছিল। কিন্তু কোন কিছুর জন্য আকাঙ্ক্ষা করা এক জিনিস, আর সেটা পেতে সংকল্পবদ্ধ হয়ে যাওয়া অন্য জিনিস।

বর্তমান যুগের ইভাঞ্জেলিক্যালরা আরেকটি ভিন্ন যুক্তি নিয়ে এসেছে, যেটা ১৯শ শতাব্দীতে ইভাঞ্জেলিক্যাল ধারণা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সময় এই বিশ্বাসের অন্তর্ভুক্ত ছিল না।১২  ইহুদিরা সবসময় চাইত, তারা যেন এই পবিত্র ভূমিতে ফিরে যেতে পারে। কিন্তু এখানে নিজেদের আবাস গড়ে তোলার পেছনে তাদের হাতে কোন যুক্তি বা অজুহাত ছিল না। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কোন সামরিক শক্তি বা সমর্থন ছিল না, যেটা এখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্য তাদের কাছে সরবরাহ করবে (আবার এখানে কন্সপাইরেসি থিওরি হচ্ছে, ১৯৪০ এর দশকে ইহুদিরা প্যালেস্টাইন যেতে চাচ্ছিল না বলে ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারকে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে জায়োনিস্টরা দেখাতে চেয়েছিল যে, তাদের জন্য এই ভূমি ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোন ভূমি নিরাপদ নয়। মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই কিন্তু প্যালেস্টাইনে ইহুদিদের ঢল নামে)। ইভাঞ্জেলিক্যাল খ্রিস্টানরাই তাদেরকে বাইবেল থেকে প্রাপ্ত যুক্তি প্রদর্শন করে বলে যে, ঈশ্বর তাদের জন্য ঐ ভূমিটি বরাদ্দ রেখেছেন। অথচ ইহুদিদের পুনর্বাসনের জন্য জায়োনিস্টরা উগান্ডা ও কেনিয়াসহ আরও অনেক জায়গার কথা বিবেচনা করেছিল; উদাহরণস্বরূপ, আর্জেন্টিনা, সাইপ্রাসের ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপ, টেক্সাস। এমনকি ১৯০৬ সাল থেকে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত টেক্সাসে The Galveston Immigration Scheme-এর অধীনে ১০,০০০ ইহুদিকে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল।১৩ কিন্তু তারা সেসব ভূমির দিকে এগোয়নি, যেটি একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান হতে পারত। কিন্তু এর পরিবর্তে তারা একটা রক্তাক্ত সমাধানের পথ বেছে নেয়। তারা জানত যে, অটোমান সুলতানরা এই পবিত্র ভূমি কোনভাবেই ছেড়ে দেবে না। তবুও কোন উদ্দেশ্যে এত রক্তাক্ত পথ মাড়িয়ে এখানেই তাদের পুনর্বাসন করায় সেটা সবসময় অজানাই থেকে যাবে।

১৯১৭ সালে ব্রিটেনের বৈদেশিক মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন প্রধান আর্থার বেলফোর কর্তৃক Balfour Declaration-কে যুদ্ধকালীন প্রয়োজন বলে বিবেচনা করা হয়; যেমন, যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধে জড়ানো এবং জার্মানীর বিরুদ্ধে রাশিয়াকে যুদ্ধে লিপ্ত রাখা। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এই ঘোষণার ৬ মাস আগে যুদ্ধে জড়িয়েছিল এবং অন্যান্য কারণগুলোও যুদ্ধ জয়ের পর অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়। তাই এই ঘোষণার পেছনে আসল কারণ যে ব্যক্তি এই ঘোষণা দিয়েছিল তার ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে জানতে পারব। ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ জফ্রে এল্ডারম্যান বলেছেন, “ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট থেকেই বেলফোর ডিক্লেরেশনের জন্ম হয়েছিল। আর্থার বেলফোর ছিলেন একজন খ্রিস্টান অতিন্দ্রীয়বাদী, যে বিশ্বাস করত যে, ঈশ্বর তাকে স্বর্গীয় পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে—কিংবা সম্ভবত মাসীহ’র আগমনের অনুঘটক হিসেবে সৃষ্টি করেছেন।”১৪ ইজরাইলি ইতিহাসবিদ টম সেগেভও একই রকম কথা বলেছেন, “এই ডিক্লেরেশনটা সামরিক বা কূটনৈতিক স্বার্থের অংশ হিসেবে সৃষ্টি হয়নি। বরং এটি বিশ্বাস আর কুসংস্কারের ফলাফল ছিল। যে মানুষরা এর উদ্যোগ নিয়েছিলেন তারা খ্রিস্টীয় জায়োনিস্ট এবং অনেকক্ষেত্রে ইহুদিবিদ্বেষী ছিলেন।”১৫

লেখাটি এই বই থেকে নেওয়া হয়েছে। আরো জানতে বইটি অর্ডার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ক্যাশ অন ডেলিভারি

সারা বাংলাদেশে ক্যাশ অন ডেলিভারি সুবিধা

সহজ রিটার্ণ ও রিফান্ড পলিসি

পণ্য প্রাপ্তির ৭ দিনের মধ্যে সহজ রিটার্ন সুবিধা

গ্যারান্টি ও নিশ্চয়তা

গুণগত মানের নিশ্চয়তা ও নিরাপদ প্যাকেজিং

100% সিকিউর চেকআউট

বিকাশ / নগদ / ব্যাংক / ক্যাশ অন ডেলিভারি

WhatsApp