ফয়েজাবাদ ৩১২২৩

হিলাল ভাট: ১৯৯২ সালের ৫ ডিসেম্বরে পত্রিকা মারফত আমরা জানতে পারলাম যে, দেড় লাখের মত করসেবক (হিন্দু জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক) অযোধ্যার বাবরি মসজিদের দিকে রওয়ানা দিয়েছে। উদ্দেশ্য, বিতর্কিত এই ভূমি দখল করা। অযোধ্যায় করসেবকদের প্রবেশ ঠেকাতে মোতায়েন করা হয় প্রচুর পুলিশ আর আধাসামরিক বাহিনী।

বাবরি মসজিদ নির্মিত হয় মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবরের হাতে, ১৫২৭ সালে। মুঘল সাম্রাজ্য ভারত শাসন করেছিলো দুই শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে। বহু বছর ধরেই এই মসজিদ নিয়ে ভারতে চলেছে আশংকাজনক রাজনীতি। বিজেপি আর উগ্র হিন্দুরা দাবি করে আসছে, হিন্দু দেবতা রামের জন্মস্থান হিসেবে এই মসজিদকে নাকি আগে বলা হতো মসজিদ-ই-জন্মস্থান। সুতরাং তাদের দাবি অনুযায়ী, তাদের এই অধিকার রয়েছে যে তারা এখানে বাবরি মসজিদ ভেঙে একটি মন্দির নির্মাণ করবে।

এই লেখাটি আজাদির লড়াই [KASHMIR – THE CASE FOR FREEDOM] বই থেকে নেওয়া।

৬ ডিসেম্বর বিকাল। আমরা লাঞ্চ করছিলাম। এমন সময় খবর এলো নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেঙে করসেবকরা মসজিদ কমপ্লেক্সে ঢুকে পড়েছে। এক অস্বস্তিকর নীরবতা নেমে এলো পুরো হলজুড়ে। কয়েক ঘন্টা পর আমরা জানতে পারলাম করসেবকরা মসজিদের তিনটে বড় গম্বুজের উপর উঠে সেগুলো মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে।

এই খবর ছড়িয়ে পড়তেই আলীগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটির ২৫,০০০-এরও বেশি ছাত্র নেমে এলো রাস্তায়। অনুপসাহারা রোডের উপর অবস্থান নিয়ে শুরু হল বিক্ষোভ, পোড়ানো হলো এক ডজন গাড়ি। বিক্ষোভরত ছাত্রদের নিয়ন্ত্রণে আনতে আনতে গভীর রাত হয়ে গেল কর্তৃপক্ষের।
পরদিন ভোরে কারফিউ জারি করা হল আলীগড়সহ উত্তর প্রদেশের অন্যান্য শহরে, একইসাথে দিল্লি আর মুম্বাইতেও। ঘটনা পরবর্তী হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় নিহত হল ২,৫০০-এরও বেশি মানুষ। দাঙ্গার পরপরই আলীগড় ও ভার্সিটি ক্যাম্পাসের কাছে সিভিল লাইন এরিয়াতে অনির্দিষ্ট কালের জন্য কারফিউ জারি করা হল।

সন্ধ্যার দিকে ফারহাত, আমার এক কাশ্মীরি বন্ধু, পাগলের মত এসে আমার দরজায় ধাক্কাতে শুরু করলো। ওর কাছ থেকে জানতে পারলাম যে কারফিউ লম্বা দিন ধরে জারি থাকবে। এজন্য ক্যাম্পাস কর্তৃপক্ষ চাচ্ছে অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্যাম্পাস বন্ধ করে দিতে। ছাত্রদের জন্য স্পেশাল বাসের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এসব বাসে করে নিরাপত্তা বাহিনীর সহায়তায় ছাত্রদের পৌঁছে দেওয়া হবে রেলওয়ে স্টেশনে, সেখান থেকে ছাত্ররা ট্রেন ধরে ফিরে যাবে বাড়িতে। ফারহাত আমাকে বলে দিল যে আমি যেতে চাইলে যেন কাল বাস ছাড়ার আগেই প্রক্টরের অফিসের সামনে থাকি। এরপর সে তাড়াহুড়া করে চলে গেল আসিফকে এই খবর জানাতে। আসিফ বোধা, মিন্টো সার্কেলের আরেক কাশ্মীরি ছাত্র।
দাঙ্গার ফলে স্কুলের ফুড সাপ্লাইয়াররা তাদের স্বাভাবিক কাজ চালিয়ে যেতে পারেনি। ওই রাতে আমি আধাপেটা হয়ে ঘুমোলাম। ভরপেট না খেতে পারার কষ্ট অনুভব হচ্ছিলো। আমার বারবার মনে পড়ে যাচ্ছিলো ওয়াজওয়ানের কথা। ঘরে বানানো একটা কাশ্মীরি সুস্বাদু খাবার, অনেক কিছু থাকে এর মধ্যে, তবে মাংসটাই আসল। স্মৃতিকাতরতায় আক্রান্ত হলাম আমি।

পরের দিন সকালে চা আর বাসি পাউরুটি দিয়ে ডাইনিং হলে নাস্তা সারার পর সোজা গেলাম ফারহাতের রুমে। ওকে জানালাম যে আমিও যাচ্ছি। তড়িঘড়ি করে রুমে ফিরে গিয়ে সবকিছু সুটকেসে ভরতে শুরু করে দিলাম। গতবছর বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হবার পর ক্লাস নাইনের বইগুলো নিয়ে বাড়ি গিয়েছিলাম। আমার মা ছিলেন শিক্ষিকা, ইসলামি সাহিত্য খুব পছন্দ করতেন। আমার ক্লাস নাইনের ধর্মতত্ত্বের বই পড়ে শিহরিত হয়ে গিয়েছিলেন। বইটা ছিল ইসলামিক উপাখ্যানের, উর্দুতে লেখা। উনি আমাকে বলে দিয়েছিলেন শীতের ছুটিতে আসার সময় ক্লাস টেনের এই বইটা নিয়ে আসতে।

কয়েকটা টিশার্ট আর জিন্স প্যান্টের সাথে বইটাও সুটকেসে ভরে দৌড়ে গেলাম ফারহাতের রুমে। ফারহাত, ছোটখাটো আর মোটাসোটা একটা ছেলে— যার বেশির ভাগ সময়ই কাটতো রিডিং রুমে, ওকে দেখলাম বাড়ি যাবার আনন্দে, উত্তেজনায় উদ্বেল হয়ে আছে। আমরা বাস ধরার জন্য প্রক্টর অফিসের দিকে হাঁটা দিলাম। গিয়ে দেখলাম আমাদের সব কাশ্মীরি বন্ধুও সেখানে বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। খুশি হয়ে গেলাম আমরা।

স্কুল থেকে পঞ্চাশ মিটার পরই বাস ভার্সিটির সরু রাস্তা ছেড়ে আলীগড়-অনুপসাহারা মেইন রোডে উঠে এলো। চারপাশের ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ আর জনশূন্যতার দৃশ্যে আমরা বিহ্বল হয়ে গেলাম। দাঙ্গাবাজদের আগুনে পুড়ে যাওয়া বাস পরিণত হয়েছে লোহার কংকালে। গুঁড়িয়ে দেওয়া ধাবা আর রাস্তার পাশের রেস্টুরেন্টগুলোর ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সবখানে। রায়টের সময়ের বিশেষ পোশাকে সজ্জিত এক পুলিশ ট্রাক ভর্তি সৈন্য তাসভির মহলের কাছে লাইন ধরে অপেক্ষা করছিলো। তাসভির মহল একটা সস্তা সিনেমা হল। আলীগড় ভার্সিটির ছাত্র আর রিকশা চালকরা ওখানে সিনেমা দেখতে যেতো।

আমরা রেলওয়ে স্টেশনে পৌঁছলাম দুইটার দিকে। লম্বা লাইন লেগে আছে দেখলাম। সবে কয়েকদিন হল, আলীগড় রেলওয়ে স্টেশন কম্পিউটারাইজড হয়েছে। অপারেটর তার ব্রান্ড নিউ কম্পিউটারের কিবোর্ড নিয়ে রীতিমতো যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। মনিটর তখনো স্বচ্ছ পলিথিন কভার দিয়ে মোড়ানো। লোকজন অপারেটরকে নিয়ে বিদ্রুপ করছিলো। ঠিক তখনই একটা ঘোষণা ভেসে এলো আমাদের কানে— “এটেনশন, যাত্রীগণ! ফয়েজাবাদ থেকে দিল্লিগামী ফয়েজাবাদ স্পেশাল ৩১২২৩, ৩ নং প্ল্যাটফর্মে অবস্থান করবে। দিল্লিগামী সব যাত্রীদেরকে অনুরোধ করা যাচ্ছে ৩ নং প্ল্যাটফর্মে চলে আসার জন্যে। ভারতীয় রেলওয়ের পক্ষ থেকে আপনাদের আনন্দময় ও আরামদায়ক ভ্রমণের শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।”
বাড়ি যাওয়ার আনন্দে আমরা এতোটাই ডুবে ছিলাম যে আমাদের মধ্যে কেউই খেয়াল করেনি এটা কোন নিয়মিত ট্রেন নয়। ফয়েজাবাদ থেকে বিশেষভাবে এই ট্রেনটা আসছিলো। সেই ফয়েজাবাদ, যেখানে মাত্র গতকালই করসেবকরা ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে।

আমরা তড়িঘড়ি করে ৩ নং প্ল্যাটফর্মে চলে গেলাম। এক মিনিট পরেই কানে এলো ট্রেনের বেসুরো হর্ন। প্ল্যাটফর্মে খুব একটা যাত্রী কেউ ছিল না। দাঙ্গার ফলে এমন একটা আতংকের অনুভূতি চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছিলো যে এটার প্রভাব পড়েছিলো রেলওয়ে স্টেশনের জীবনেও। লাল অ্যাপ্রন পরা কুলি, চায়ের দোকানদার, পত্রিকা-ম্যাগাজিন ওয়ালা, কারোরই দেখা মিললো না।

ইঞ্জিনের গর্জনের মধ্যেই ট্রেনে উঠে পড়লাম। আমার সাথে ফারহাত আর জাভিদ ইন্দ্রাবিও উঠে পড়লো। জাভিদ আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থী ছিলেন এবং দক্ষিণ কাশ্মীরের রত্নিপোরা গ্রামে তার বাড়িতে যাচ্ছিলেন।

আমার সাথের অন্যান্য কাশ্মীরি ছাত্ররা পেছনের দরজা দিয়ে একই কোচে উঠলো। আমি ট্রেনের ভিতরে হেঁটে হেঁটে ওদের দিকে এগুতে থাকলাম। আশপাশে সব আধা ঘুমে বিভোর যাত্রী। কোচটি ছিল যাত্রীতে ঠাসা। এরকম চার-পাঁচটা বার্থ পেরুনোর পর আমি সিট পাবার আশা ছেড়ে দিলাম। সুটকেস নামিয়ে দু’পায়ের মাঝে রেখে দিলাম। কিছুক্ষণের জন্য ওই করিডোরেই দাঁড়িয়ে রইলাম। একটু পরে নজরে পড়লো ফারহাত আর জাভিদকে, আমার থেকে কয়েক বার্থ পেছনেই। ফারহাত চুইংগাম চিবুচ্ছিলো। আমাকে দেখে চমকে উঠলো। জাভিদ তার ঠিক পেছনেই ছিল। কলার থেকে হাতের কফ পর্যন্ত সাদা রেখাওয়ালা একটা নীল কালারের পুলওভার পরা ছিল তার। ওয়াকম্যান কানে লাগিয়ে শুনছিলেন তিনি।

করিডোরের অন্যপাশের বার্থের দিকে আমার নজর পড়লো। বগির নিচের বার্থে প্রায় দশজন মানুষ মুখোমুখি বসে আছে ওখানে। কয়েকজন কার্ড খেলছে, বাকিরা মনোযোগ দিয়ে সেটা দেখছে। প্রায় অর্ধেক লোকই বিড়ি ফুঁকছে। সাদা জামা আর ধুতি পরা এক লোক ডান হাতে বিড়ি আর বাম হাতে কয়েকটা কার্ড ধরে রেখে আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো, “ভায়া, আগে চালো আগে!” (ভাই, সামনে আগাও!)
আমি জবাব দিলাম, ”আগে কাঁহা, আগে কোয়ি জাগা নেহি হ্যায়।” (সামনে কোথায়, সামনে কোন জায়গা নেই।)

লোকটি থমকে গেল। চেয়ে রইলো আমার দিকে। পরক্ষণেই চেঁচিয়ে উঠলো, “আরে ইয়ে তো কাশ্মীরি লাগতা হ্যায়!” (আরে, একে তো কাশ্মীরি বলে মনে হয়!) আমি কোন শব্দ উচ্চারণের আগেই সে বলে উঠলো, “মারোওওও!” (একে মেরে ফেলো!)

কয়েক মুহূর্ত পরে, উপরের বার্থের লোকেরা নেমে এসে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। তাদের মধ্যে কয়েকজন চড় মারতে আরম্ভ করলো, কেউ লাথি মারতে লাগলো। একজন বিশাল, ভারী লোক আমাকে পিছন থেকে ধরে আমার গলায় ছুরি ইঙ্গিত করে। ও আমার গলা কেটে দেওয়ার আগে আমি চিৎকার শুরু করলাম, “আমি একজন কাশ্মীরি পণ্ডিত! প্লিজ, আমাকে মারবেন না! আমার চাচাকে কাশ্মীরে খুন করা হয়েছে। কাশ্মীরি মুসলিমরা আমাদের ঘর পুড়িয়ে দিয়েছে। আমাদের উপত্যকা থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। আমি এখন জম্মুর এক মাইগ্র্যান্ট ক্যাম্পে থাকি।”

লোকগুলো থেমে গেলো। এদের মধ্যে নেতাগোছের লোকটি তার এক সহযাত্রী লাথি মেরে সিট থেকে সরিয়ে দিয়ে আমাকে বসতে আদেশ করলো।

“তোমার নাম কি?”
“হিলাল ভাট।” ভাট শব্দটার শেষের দিকে জোর দিয়ে বললাম হিন্দুয়ানি উচ্চারণে।
“তোমার বাবার নাম কি?” সে জিজ্ঞেস করলো।
“বদ্রী ভাট”, জবাব দিলাম আমি। আমার বেশ কিছু হিন্দু নাম জানা আছে। এরা হল কাশ্মীরে আমার আশপাশের পণ্ডিত সম্প্রদায়ের বন্ধু, শিক্ষক আর প্রতিবেশী। বদ্রী নামের প্রথম অক্ষরের সাথে আমার বাবার নাম, বশির, এর প্রথম অক্ষরটা মিলে যায়।

আর কোন প্রশ্ন করা হলো না। বার্থের কোণার দিকে একটা সিট দখল করার পর আমি খেয়াল করলাম উল্টোপাশের সিটের নিচে এক ডজন জীর্ণ ইট। আমার দৃষ্টি অনুসরণ করে আমার সাথের এক লোক আমাকে জানালো যে এগুলো সদ্য ধ্বংসপ্রাপ্ত বাবরি মসজিদের ইট। এগুলো তাদের বিজয়ের চিহ্ন, গ্রামে নিয়ে যাচ্ছে গর্বের সাথে সেগুলো সবাইকে দেখাবে বলে। আমি বুঝতে পারলাম, এরা হচ্ছে অযোধ্যা ফেরত করসেবক।

এর পরে যা ঘটলো সেটা সম্পর্কে আমার স্মৃতি অনেকটা এরকম— টিভি স্ক্রিনে চলতে থাকা একটা দ্রুতগতির একশন শট, তারপর হঠাৎ করেই পাওয়ার কাট হয়ে টিভি স্ক্রিন খালি।

ফারহাত আর জাভিদকেও আক্রমণ করলো করসেবকরা। ওরা আমার মত মিথ্যা পরিচয় দিতে পারেনি। আমি যেটুকু মনে করতে পারি যে, ফারহাত দুই হাত দিয়ে তার মুখ ঢাকছিলো। কেউ একজন ফারহাতের বুকে ত্রিশূল ঢুকিয়ে দিতেই সে চিৎকার করে বলে উঠলো, “হাতাই মোজাই!” (ওহ মা!)

বিশ্রীভাবে কাপড় পরা এক লোক ওর ঘাড়ে ছোরা বসিয়ে দিল। রক্তের ফোয়ারা ছুটতে লাগলো আমার বন্ধুর গলা থেকে। তারপর আবার সেই টিভির পাওয়ার কাট মুহূর্ত— সবকিছু আবার অদৃশ্য হয়ে গেল।

এটাই ছিল শেষবারের মত আমার বন্ধুকে দেখা। আমি দেখিনি জাভিদের কি হয়েছিলো। সে ছিল আরো কয়েক বার্থ পরে, আমার দৃষ্টিসীমার বাইরে। ওখানেই ওকে আক্রমণ করা হয়। এক মাস যাওয়ার আগ পর্যন্ত জাভিদের লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি। এক মাস পর বুলন্দশহরের এক ছোট গ্রামে জাভিদের কবর শনাক্ত করে তার পরিবার। স্থানীয় একজন ইমাম তার দাফনের ব্যবস্থা করেছিলেন। ফারহাতের লাশ বাড়ি পৌঁছায় তিনদিন পর।

পাঁচ-দশ মিনিট পর গ্যাং লিডার ফিরে আসে। তার সাদা জামা রক্তে মাখামাখি। আমি শুনতে পেলাম সে বলছে, “আমি তাদের কেটে টুকরো টুকরো করে বাইরে ছুড়ে ফেলেছি।” সে তার রক্তমাখা জামা খুলে জানালা দিয়ে বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিলো।

আমার দিকে ফিরে বললো, সে এতে খুশি হয়েছে যে আমি ঠিক সময়মতো আমার পরিচয় জানিয়েছি। আমাকে কথা দিল পরেরবার জম্মুতে বৈষ্ণব দেবীতে সে আমাকে দেখতে আসবে। বৈষ্ণব দেবী হলো জম্মুর টিলার উপর অবস্থিত একটি মন্দির যাতে হাজারো তীর্থযাত্রী প্রতিবছর তীর্থে আসে।

ট্রেন দিল্লির পথে চলতে থাকলো। খুরজার কাছে কোন জায়গায় ক্ষুব্ধ মুসলিমদের একটি দল পাথরের মজুদ নিয়ে রেললাইনের পাশে জড়ো হয়েছিলো। ফয়েজাবাদ স্পেশাল স্টেশন অতিক্রমকালে তারা ট্রেনের উপর পাথর ছুড়তে লাগলো। করসেবকরা জানালার উপরে লোহার শাটারগুলো নামিয়ে দিতে থাকলো। কোচের দমবন্ধ পরিবেশ আরো অন্ধকারে ডুবে যেতে থাকলো।

কয়েক মিনিট পর, কেউ একজন ঘোষণা করলো এই কোচে আরো কাশ্মীরি রয়েছে। কয়েকজন করসেবক হাতে ত্রিশূল, ছুরি আর তরবারি নিয়ে দেখতে গেল আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আমার বাকি সব কাশ্মীরি বন্ধুদের ঘিরে ফেলা হলো। আমি যে বার্থে বসেছিলাম সেটা ইতিমধ্যেই খালি হয়ে গেছে। ওদেরকে তাই বলা হল বসে পড়তে।

করসেবকরা সবার ব্যাগ আর সুটকেস সার্চ করতে শুরু করলো দামি কোন কিছু পাবার আশায়। মায়ের জন্য নিয়ে যাওয়া উর্দু বইটার কথা মনে হতেই আমি ভয়ে কাঁপতে শুরু করলাম। আমি সিট থেকে উঠে দাঁড়ালাম। আমার সুটকেস তুলে নিয়ে চেক হয়ে যাওয়া লাগেজের মধ্য দিয়ে তুলে আনতে চেষ্টা করলাম। গ্যাং লিডার সুটকেসটা ধরে ফেললো। জিজ্ঞেস করলো, কি করছি আমি। আমি নার্ভাসভাবে জবাব দিলাম এটা আমার এবং সে এটা চেক করতে চাইলে আমি কিছু মনে করব না।

“না। যদি এটা তোমার হয় তো ঠিক আছে। তুমি আমাদের ভাই। তোমার বরং এই ব্যাগগুলো চেক করতে আমাদের সাহায্য করা উচিত।”
রফিক আহমেদ ভাই ছিলেন মৎস বিদ্যায় স্নাতকোত্তর। ফয়েজাবাদ স্পেশাল ট্রেনে থাকা কাশ্মীরি ছাত্রদের মধ্যে সবচেয়ে বড়। তিনি টয়লেটে যেতে চাচ্ছিলেন কিন্তু তাকে অনুমতি দেওয়া হচ্ছিলো না। তিনি তখন ভয় দেখালেন যে এরকম করলে সিটেই প্রস্রাব করা ছাড়া তার আর কোন উপায় থাকবে না।

লিডার তখন দুটো ছেলেকে দিয়ে তাকে টয়লেটে পাঠালো। রফিক ভাই ভেতরে ঢুকে লোহার দরজাটি ঘুরিয়ে লাগিয়ে দিলেন। কয়েক মিনিট পর করসেবকরা বাইরে থেকে ধাক্কা দিতে শুরু করলো, কিন্তু রফিক ভাই কোন জবাব দিলেন না। তারা তখন দরজায় লাথি মারতে লাগলো। কিন্তু রফিক ভাই তখনও চুপ মেরে থাকলেন। “তুই বাইরে এলে তোকে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলবো,” পাহারাদার হুমকি দিলো। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই নিজেদের সিটে ফিরে এলো তারা।

ট্রেন আস্তে আস্তে খুরজা স্টেশনের ভেতরে টেনে টেনে চলতে থাকলো। ট্রেন পুরো থেমে যেতেই রফিক ভাই আস্তে করে টয়লেটের দরজা খুলে লাফ দিয়ে ট্রেন থেকে নেমে পড়লেন।

আমি জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখতে পেলাম রফিক ভাই রেললাইন ধরে দৌড়ুচ্ছেন। ছুরি হাতে করসেবকরা তার পেছনে দৌড়াচ্ছে আর বলছে, “কাশ্মীরি দেহশাতগার্দ!” (কাশ্মীরি সন্ত্রাসী)

উনি প্ল্যাটফর্মে লাফ দিয়ে ওঠার আগেই একজন করসেবক তাকে ধরে ফেললো, ছুরির পাড় বসিয়ে দিলো তার মাথায়। ট্রেনের হর্ন বাজিয়ে স্টেশন ছাড়তে শুরু করলে করসেবকরা উল্টো ফিরে দৌড়ুতে শুরু করলো। পেছনে ফেলে গেল রক্তপুকুরে হাবুডুবু খাওয়া রফিক ভাইকে।
দিল্লি এখনো এক ঘণ্টার পথ। কোন নিশ্চয়তা নেই যে তারা আমার পাজামা টেনে চেক করতে চাইবে না আমি মুসলিম কিনা। আমি আমার মুসলিম পরিচয় লুকাতে পেরেছি ভালোভাবেই, কিন্তু শারীরিক পরীক্ষা? কি হবে যদি কেউ আমাকে প্রশ্ন করে বসে যে, একজন হিন্দু হয়ে কেন আমি পড়াশোনার জন্য মুসলিম ভার্সিটি বেছে নিলাম? কি হবে যদি কেউ আমার সুটকেস খুলে উর্দু বইটা পেয়ে যায়? সিদ্ধান্ত নিলাম সুযোগ পাওয়া মাত্রই ট্রেন থেকে নেমে পড়বো।

তন্ন তন্ন করে সবার লাগেজ চেক করার পর সব কাশ্মীরি ছাত্রদের বলা হল লাইন দিয়ে দাঁড়াতে। তারপর চলন্ত ট্রেন থেকে তাদের বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হল। এটা স্রেফ ভাগ্য যে এদের মধ্যে কেউই মারা যায়নি।

ট্রেন পরবর্তী স্টপেজ গাজিয়াবাদ স্টেশনের কাছে আসতেই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম নেমে যাবার। আমি বিনয়ের সাথে করসেবকদের জানালাম যে আমার একজন চাচা এখানে থাকেন আর বাড়ি যাবার আগে তার সাথে একবার দেখা করে যাব আমি। আমি তাদের জম্মুতে আমার নকল ঠিকানা দিয়ে কোচের পেছন দরজার দিকে এগিয়ে যেতে থাকলাম। ট্রেন আস্তে আস্তে থামতে শুরু করলো। আমি দরজায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলাম প্ল্যাটফর্মে পৌঁছে ট্রেন থামার। কিন্তু এর আগেই কেউ পেছন থেকে আমাকে এতো জোরে লাথি দিলো যে আমি ট্রেনের বাইরে পড়ে গেলাম।

সমস্ত ব্যথা-বেদনা ভুলে গিয়ে আমি উঠে দাঁড়ালাম। প্ল্যাটফর্মের উপর নজর বুলিয়ে প্রায় তিনশ’ মিটার দূরে এক খাকি পোশাকধারীকে দেখতে পেলাম। আমি দৌড়ে গেলাম তার দিকে, চিৎকার করে বললাম, “আমাকে সাহায্য করুন, প্লিজ, ওরা আমাকে মেরে ফেলবে! প্লিজ সাহায্য করুন আমায়, আমাকে ওরা মেরে ফেলবে!”

“কে মেরে ফেলবে তোমাকে?” লোকটি জানতে চাইলো।

পেছন ফিরে চাইলাম আমি। কেউ নেই। আমি ধরে নিয়েছিলাম যে লোকগুলো তাদের ছুরি নিয়ে আমার পেছনে দৌড়ে আসছে। এতোক্ষণে আমি খেয়াল করলাম যে লোকটি রেলওয়ে সুইপার। আমি তাকে সব খুলে বললাম। কি হয়েছে ফারহাত, জাভিদ আর রফিকের সাথে, সবকিছু খুলে বললাম।

“তোমার উচিত পুলিশের সাথে কথা বলা। এক নাম্বার প্ল্যাটফর্মে একটা পুলিশ স্টেশন আছে।”

আমি প্ল্যাটফর্ম ধরে হেঁটে চললাম। ততোক্ষণে ফয়েজাবাদ স্পেশাল স্টেশন ছেড়ে চলে গেছে। তার জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে একটা লোকাল ট্রেন। একটা সাইনবোর্ড চোখে পড়লো, “পুলিশ”। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলাম। মধ্যবয়স্ক এক পুলিশ চেয়ারে বসে কিছু কাগজপত্র দেখছিলো। আমি তাকে খুলে বললাম কি ঘটেছে।

“আপনি অপেক্ষা করুন। আমি আমাদের সাহেবকে ডেকে নিয়ে আসি”, জানালো সে।

অপেক্ষা করতে লাগলাম। ঘরের চারপাশে নজর বুলাচ্ছিলাম, এমন সময় চোখে পড়লো রামের বিশাল ফ্রেমওয়ালা ছবি দেয়ালে ঝুলছে। ফুলের মালায় সাজিয়ে রাখা ছিল ছবিটি। বেশ কিছু ধূপধারীর অবশিষ্টাংশ ফ্রেমের নিচে আটকে রাখা হয়েছিলো। তাদের ছাই ঠিক নিচের সিমেন্ট দিয়ে বাঁধাই করা অনাবৃত মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলো।

আমি হুট করে সিদ্ধান্ত নিলাম আমার পুলিশ অফিস থেকে পালিয়ে যাওয়া উচিত। আমি দরজা ফুঁড়ে বের হয়ে গেলাম। এসে থামলাম দিল্লিগামী একটি খালি কোচের কাছে। ভেতরে ঢুকে দেখলাম কোণার দিকে কেউ একজন বসে আছে। তার মাথা কাপড় দিয়ে পেঁচানো আর মানুষটা হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে রেখেছে তার ব্যাগ। কাছে এগিয়ে গেলাম আমি আর সাথে সাথে কেঁপে উঠলাম একটা হালকা ঝাঁকুনিতে; “হিলাল!”

আসিফ, আমার মিন্টো সার্কেলের সহপাঠী। করসেবকরা তাকেও ট্রেন থেকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলো। কিন্তু বেঁচে গেছে সে। ডান হাত ভেঙে গেছে ওর। মাথার ক্ষত থেকে রক্ত ঝরছে। ব্যাগ থেকে এক জোড়া ট্রাউজার বের করে মাথায় পেঁচিয়ে নিয়েছে রক্ত পড়া বন্ধ করার জন্য।
ট্রেন চলতে শুরু করলে আসিফ কাপড় বদলে নিলো। রক্তে ভেজা শার্ট আর ট্রাউজারগুলো ব্যাগের মধ্যে রেখে দিলো। পরের এক ঘণ্টা আমরা একটা শব্দও উচ্চারণ করিনি। ফারহাত, জাভিদ কিংবা রফিক, কারো কথাই না।

নয়াদিল্লি রেলওয়ে স্টেশনে জম্মুগামী শালিমার এক্সপ্রেস অপেক্ষা করছিল যাত্রীদের জন্য। আমরা প্রতিটি কোচ খুঁজে দেখলাম। দেখলাম পাগড়ি আর লম্বা দাঁড়িওয়ালা কোন লোকজনের দেখা পাওয়া যায় কিনা। অবশেষে একটা কোচ পেলাম আর বাকি পথটুকু শিখদের সাথে নিরাপদেই পার হলাম।

হিলাল ভাট
কাশ্মীরি সাংবাদিক।

Leave a Reply